You are currently viewing পরিবার_মেগা সিরিয়াল_আসক্তি_ভাঙ্গন

পরিবার_মেগা সিরিয়াল_আসক্তি_ভাঙ্গন

।।পরিবার।।

প্রতিটা মানুষের কাছেই পবিত্র একটা শব্দ। আর প্রতিটা মানুষই, সে ভালই হোক বা খারাপ, তার একটা সুন্দর পরিবার তৈরি করে সেটাকে সারাজীবন সুখী করে রাখতে চায়।  বাবা, মা, ভাই, বোন, দাদা, দিদি, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, দাদু, দিদা, স্ত্রী, স্বামী, সন্তান (আরও অনেক সদস্য হয়ত অনিচ্ছাকৃতভাবে বাদ পড়ে থাকতে পারে) – এরাই পরিবারের অংশ বা সদস্য। সুখী পরিবার বলতে যা বোঝায়, সেটা হল উল্লিখিত প্রতিটা ব্যাক্তির মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বা বোঝাপড়া। এই সম্পর্ক ‘সু’ থেকে ‘কু’ তে পরিণত হলেই পরিবারে ভাঙ্গন ধরে। এই ভাঙ্গনের কারন বিভিন্ন হতে পারে, যেমন – আর্থিক সমস্যা, হতাশা, দুশ্চিন্তা, শোক, পারিবারিক কোন সমস্যা, বিষয়-সম্পত্তি জনিত কারণে বিবাদ ইত্যাদি। এই কারণ গুলি খুবই প্রচলিত যা যুগ যুগান্তর ধরে চলে আসছে। এইসব কারণে পরিবার ভেঙ্গে গেলে পুণরায় অনেক কসরত করেও তা কখনো কখনো জোড়া লাগানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে। কিন্তু পরিবার ভাঙ্গনের পেছনে জোড়ালো যে বিষয়টার অবদান থাকে, তা হল সদস্যদের মধ্যে পারিবারিক মনোমালিন্য। পূর্বে উল্লিখিত সমস্যাগুলো কোনো পরিবারে না থাকলেও শুধুমাত্র ‘মনোমালিন্য’র কারণে পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এবং ইদানিং সেটাই দ্রুতগতিতে ঘটে চলেছে। এই মনোমালিন্যেরও বহু কারণ থাকে, উল্লিখিত সমস্ত প্রচলিত কারণগুলির পাশাপাশি আরও অন্যান্য ব্যাক্তিগত কারণও এর পিছনে কাজ করে। সেটা জানতে হলে ধ্বংসের পথে যাওয়া পরিবারকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, কারণ, এক একটা পরিবারের ক্ষেত্রে সমস্যা বা মনোমালিন্যের বিষয়ও এক একরকম। কিন্তু একটা মজার ব্যাপার হল ‘বিষয়’ আলাদা হলেও পারস্পরিক মনোমালিন্যের ‘উৎস’ কিন্তু ইদানিং কালে সর্বক্ষেত্রে একইরকম। হঠা্ত-ই সেই উৎসের সন্ধান আমি সম্প্রতি পেলাম – যা হল বর্তমান দিনে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত “মেগা সিরিয়াল”, যা একটা পরিবার ধ্বংসের ক্ষেত্রে ম্যাজিকের মত কাজ করে। বলা যেতে পারে ৯০% বা তার বেশী মেগা সিরিয়ালই এখন বিষ’এর মতো। পূর্বে কোনো এক সময় এই মেগা সিরিয়াল বন্ধের জন্য এবং এর খারাপ দিক নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ঝড় উঠেছিল। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ঝড় থেমে গেলে আবার যে কে সেই, মানে মেগা সিরিয়াল শুরু এবং এর পরোক্ষ প্রভাবে একের পর এক পরিবার ধ্বংস, তবে সব পরিবার নয়। যেসব পরিবার মেগা সিরিয়ালের প্রভাবেও ধ্বংস হচ্ছে না, তার পেছনে বড়সড় কারণ রয়েছে – যা হল ‘নিয়ন্ত্রণ‘। মেগা সিরিয়াল বন্ধ করার দাবি এখানে জানানো হচ্ছে না, কারণ সেটা উদ্বেগের বিষয় নয়। এই ব্লগে আমি এটাই আলোচনা করবো যে, কোন কোন পরিবার মেগা সিরিয়ালের কুপ্রভাবে ধ্বংস হচ্ছে, এবং কোন কোন পরিবার নিজের উপর কুপ্রভাব বিস্তার করা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হচ্ছে, যা কিনা নিয়ন্ত্রণ, সেই বিষয়ে। চলুন, শুরু করা যাক ……

প্রথমেই একটা প্রশ্ন, টেলিভিশনে সম্প্রচারিত মেগা সিরিয়ালের ‘শিকার’ কে বা কারা হয়? এক কথায় উত্তর দেওয়া যায় যে, পরিবারের গৃহবধূ-রাই মেগা সিরিয়ালের কবলে সবথেকে বেশী পড়ে। পরিবারের এই সদস্যরাই হলেন প্রত্যক্ষ শিকার। আর পরোক্ষ শিকার হিসাবে ইদানিং বাড়ির বয়স্ক পুরুষ যেমন, দাদু বা ঠাকুরদা, অবসরপ্রাপ্ত বাবা, জ্যেঠু এবং কাকু – এঁদের নাম করা যায়। এঁরা কখনো নিয়মিত দর্শক বা কখনো না হলেও প্রতিটি মেগা সিরিয়ালের ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন। আর পরিবারের একদল সদস্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেগা সিরিয়ালের শিকার হয়ে পড়ে দিনের দ্বিতীয়াংশে বাড়ি থাকার কারণে। কারণ, ঐ দ্বিতীয়াংশে সম্পূর্ণ পরিবারটিই মেগা সিরিয়ালের শিকার হয়ে যায়, এবং পরিবারের অংশ হিসাবে ঐ ব্যাক্তিরা পার্শ্ববর্তী কো্নো কক্ষে বিরাজ করা সত্ত্বেও সিরিয়ালের শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে। সেইরকম আক্রান্ত হওয়া থেকেই হয়ত আমি পারিবারিক মনোমালিন্যের উৎস খুঁজে পেলাম এবং এই ব্লগ লিখতে বসলাম। যাক, শাপে বর-ই হয়েছে। তবে একটা বিষয়, মেগা সিরিয়াল দেখা থেকে কাউকে বঞ্চিত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া বা আবেদন জানানোর সাহস বা অধিকার কোনোটাই আমার নেই। কারণ, গৃহবধূদের অবসর সময় অতিবাহন করার জন্য এই একটিই জিনিস, যা তাঁরা উপভোগ করে থাকেন, সেটা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা অপরাধ। তাই শুধু কয়েকটা বিষয়ে দৃষ্টিগোচর করানোই আমার উদ্দেশ্য। শুরু করি ……

মেগা সিরিয়াল প্রস্তুতকারীরা সুখের ঠিকানা, দুখের ঠিকানা কখনোই পায় না, শুধু যেটা পায়, সেটা হল ঝগড়া, অশান্তি, ষড়যন্ত্র, শত্রুতা – ইত্যাদির ঠিকানা। তাই তাদের সিরিয়ালের বিষয়বস্তুকেও এর বাইরে নিয়ে যেতে পারে না। সুখের কথা বাদ দিন, দুঃখের কোনো ঘটনা নিয়েও যদি কোনো গল্প তৈরি করে সেটাকে নাটকে রূপান্তরিত করে দেখান হয়, বরং ভালোই লাগে। কিন্তু মাস্টার মাইন্ড প্রস্তুতকারীরা এসবের সন্ধান পায় না বা পেলেও সেগুলোকে গায়েব করে দেয়। পরে থাকে শুধু ঝগড়া, অশান্তির মত বিষয়। এর কুপ্রভাব ত পরবেই। আমার এই ব্লগ’টার নামকরণ করেছি “পরিবার_মেগা সিরিয়াল_আসক্তি_ভাঙ্গন”। এই পর্যন্ত একটা ধারণা পাওয়া গেল যে একটি পরিবার মেগা সিরিয়ালের কুপ্রভাবে ভেঙ্গে যেতে পারে। কিন্তু ‘আসক্তি’!! নামকরণের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য কি?? এখানে বলে রাখি, পরিবারের ভাঙ্গন সবসময় মেগা সিরিয়ালের কারণে হয়ে থাকে না, যেটার কারণে হয়ে থাকে, সেটা হল, ‘আসক্তি’, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Addiction’, এর প্রভাব কিভাবে পড়ে, সেটা এখন বলব। আমরা সবাই জানি, যেকোনো জিনিসই অতিরিক্ত খারাপ, যেমন, ধূমপান, মদ্যপান, মোবাইলের ব্যবহার, টি.ভি. দেখা ইত্যাদি। কোনো জিনিসের প্রতি মাত্রারিক্ত নেশাই হল আসক্তি। আর আসক্তি নিশ্চিতভাবেই শরীর ও মনের উপর প্রভাব ফেলে থাকে। তাই অন্যান্য আসক্তির মত মেগা সিরিয়াল দেখার আসক্তিও প্রভাব ফেলে থাকে, যা হল পরিবার ভাঙ্গন। কিন্তু কিভাবে?? আসুন আলোচনা করা যাক ……

আগেই বলেছি যে, সিরিয়াল প্রস্তুতকারীদের প্রধান বিষয় হচ্ছে ঝগড়া, অশান্তি, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি। এই বিষয়গুলিই তারা সিরিয়ালে ফুটিয়ে তুলতে আমরণ ব্যস্ত থাকে। তার কারণ এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি না। কারণ, এখনকার সমাজব্যবস্থার একটা বড় অংশ দ্রব্যের গুণাগুণ বিচার না করে কেবলমাত্র বাণিজ্য করতেই ব্যস্ত। থাক সে কথা! এখন বিষয় হল, প্রতিটা দর্শক যদি দিনের একটা বড় অংশে বিভিন্ন ঝগড়া, অশান্তিতে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে সর্বদা ব্যস্ত থাকে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মস্তিষ্কের অধিকাংশ পজেটিভ দিকগুলো নেগেটিভিটিতে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। আসক্তি এবং তার প্রভাবের উদাহরণস্বরূপ আমরা এটা বলতেই পারি। ঠিক যেমন, ধূমপান, মদ্যপান, গেম খেলা ইত্যাদির প্রতি আসক্তি আমাদের শরীরে কঠিনভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এইভাবেই দর্শকদের বা সদস্যদের ঐসব রূপান্তরিত নেগেটিভ মস্তিস্ক থেকেই মনোমালিন্যের সৃষ্টি। সেকারণেই বাবা-মা—–সন্তান, স্বামী—–স্ত্রী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ী—–পুত্রবধূ এবং পরিবারের অন্যান্য সম্পর্কগুলিতে যদি পরস্পর পরস্পরের প্রতি কোনো যুক্তিযুক্ত বা যুক্তিহীন বিবাদের সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে সিরিয়ালের কুপ্রভাবে প্রভাবিত প্রতিটা সদস্যই ঐ বিবাদের সঙ্গে সিরিয়ালের কোনো না কোনো বিবাদের যোগসূত্র ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে স্থাপন করে ফেলে, আর তখনই সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই সমস্যা থেকেই সংসারের ভাঙ্গন। আর ধুরন্ধর সিরিয়াল প্রস্তুতকারীরা সমস্যা তৈরীতে এতটাই নিপুণ যে, পরিবারের সব ধরণের এবং সকল স্তরের সমস্যাগুলিকে ফুটিয়ে তুলতে তাদের কোনো অসুবিধাই হয় না। সোজা বাংলা ভাষায় হল – প্রতিটি পরিবারে ঝগড়া, অশান্তির মূল যে কারণ থাকে সেগুলো আপনি প্রতিটি সিরিয়ালেই পাবেন যাতে আপনাদের নিজেদের সমস্যাগুলির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে অসুবিধা না হয়। আর ঐযোগসূত্র স্থাপনই সমস্যাকে জটিল থেকে জটিলতর করার জন্য যথেষ্ট। এটা নিঃসন্দেহেই এক ধরণের পরিকল্পনা মাফিক কাজ। সবশেষে বলি, মেগা সিরিয়ালের এই কুপ্রভাব এখ্নো ১০০% পরিবার ধ্বংসে সফল হতে পারেনি, কারণ, দর্শকদের একটা অংশ এখনো বিচক্ষণ, যারা সিরিয়াল শুধু চোখ দিয়ে উপভোগ করে থাকেন, মাথা ও মন দিয়ে নয়। এই বিচক্ষণতার যেদিন বিনাশ ঘটবে, সেদিন কোনো পরিবারই যে আর টিকে থাকবে না, সেটা বলাই বাহুল্য।

আমার আবেদনঃ পরিবার একজন মানুষের কাছে খুবই গুরত্বপূরণ। কেবলমাত্র সিরিয়াল দেখে, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরিবারের মূল্যবান সম্পদ (বিভিন্ন সম্পর্ক) গুলিকে অবহেলা, পরস্পরের প্রতি ভুল ধারণা, পরস্পর পরস্পরের দ্বারা অহেতুক আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া বা পরস্পর পরস্পরকে আঘাত করা, ঝগড়া, বিবাদ, মনোমালিন্য, অমান্যতা, উশৃঙ্খলতা, পরস্পর পরস্পরের মতামতকে প্রাধান্য না দেওয়া, বদনাম, অপবাদ, অপমান, একে অন্যের কাজে নালিশ, পরস্পর পরস্পরের ভাল কাজে বাধাদান – এই সবে নিজেকে লিপ্ত না করে সমস্যাগুলিকে আলোচনার মাধ্যমে মেটানোর চেষ্টা করুন। একঘেয়ে জীবন কাটানোর বিরতি হিসাবে মশলাদার মেগা সিরিয়াল উপভোগ করার অধিকার আপনার একান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু সেটাকে শুধুমাত্র উপভোগ্য বিষয় হিসাবেই বিবেচনা করুন। আর নিজের পরিবারকে একটা মন্দিরের ন্যয় বিবেচনা করুন। দুটোকে মিল করালেই সিরিয়ালের প্রভাবে আপনার মন্দির বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর সবসময় মনে রাখবেন, সিরিয়াল প্রস্তুতকারীদের পকেট আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আপনার দ্বারা খরচ করা ইলেকট্রিক বিল, টেলিভিশনের দাম, কেবল কানেকশানের বিলের টাকা আর আপনার নষ্ট করা মূল্যবান সময়ের দ্বারাই ফুলে ফেঁপে উপছে পড়ুক, তাতে কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু সেটা যেন আপনার পরিবার ভেঙ্গে বা পরিবারকে ধ্বংস করার মাধ্যমে না হয়!! বিষয়টা সম্পূর্ণই আপনার হাতে।।

।।ধন্যবাদ।।

Leave a Reply